বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:২০ পূর্বাহ্ন
বি. চৌধুরী বিষয়ক প্যাঁচাল এখন তামাদি। এসকে সিনহা ক্যাচালও শেষ। ল্যাঠাও মিটে গেছে বলা যায়। কিন্তু শেষ হয়েও এ ধরনের কেস কি শেষ হয়? এর জের সইতেই হয়। এতে নানান নাকানি-চুবানিতে নির্দিষ্ট ব্যক্তিটির বিদায় ঘটে। তিনি হেরেছেন মনে করা হয়। কিন্তু জয় হয় কার? বরং ক্ষয় নিশ্চিত হয় অনেকেরই। হারে বাদবাকি সবাই। এমনকি তা মন্দ রেওয়াজ হিসেবে গেঁথে যায় দেশের ইতিহাসে। এছাড়া এ নিয়ে কথামালা গড়ায় সংবিধানের চৌহদ্দি ডিঙিয়ে ঘাটে-মাঠেও। যার মন যা চায়, তাই বলেন। বক্তার পক্ষে সমর্থকও থাকে প্রচুর, অগুনতি। অযুতে-নিযুতে। নানা রটনা-ঘটনায় সদ্য বিদায়ী প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাকে নিয়েও তা-ই হয়েছে। এখনো হচ্ছে। চলছে হরদম। কথার সঙ্গে আকথা, প্রসঙ্গ ছাড়িয়ে অপ্রাসঙ্গিক নানা কথার সঙ্গে গুজবও অন্তহীন।
অনেকের মনে থাকার কথা বিএনপি-জামায়াত আমলে রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক বি. চৌধুরীকে বিদায় এবং রাজপথে তাদের বাপ-বেটাকে ধাওয়ানোর কথা। বি. চৌধুরীকে ওই দৌড়ে হারানোর কাজটি করতে পেরে তখনকার শাসক শ্রেণি নিজেদের বিজয়ী ভেবেছে। আসলে কি বি. চৌধুরী একাই হেরেছিলেন? সেই দায় কি আজও টানছে না বিএনপি? ভুগছে না সেই পাপে?
‘অনেকের মনে থাকার কথা বিএনপি-জামায়াত আমলে রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক বি. চৌধুরীকে বিদায় এবং রাজপথে তাদের বাপ-বেটাকে ধাওয়ানোর কথা। বি. চৌধুরীকে ওই দৌড়ে হারানোর কাজটি করতে পেরে তখনকার শাসক শ্রেণি নিজেদের বিজয়ী ভেবেছে। আসলে কি বি. চৌধুরী একাই হেরেছিলেন? সেই দায় কি আজও টানছে না বিএনপি? ভুগছে না সেই পাপে?’
উপরের দুই ঘটনার চেয়ে কিছুটা ভিন্নমাত্রার এমন আরেকটি সাংবিধানিক হারজিতের খেলা ঘটেছে ২০০৭ সালে। বহুল আলোচিত সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি এম এ আজিজকে খেদানো হয়েছিল গোটা কমিশনসহ। ১০ বছর আগে নবম সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে ২২ জানুয়ারি নির্বাচনের ঘোষণা করেছিল আজিজ কমিশন। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ তখন নিজে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নিয়ে প্যাঁচের মধ্যে পাকিয়ে বসেন আগামাথাহীন নতুন প্যাঁচালি। এরপরই ওয়ান ইলেভেন।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আগমন। প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বে ফখরুদ্দীন আহমদ। পরে শুধু তফসিলই বাতিল হয়নি। কমিশনকেও পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। এতে তখনকার বিরোধীপক্ষ নিজেদের বিজয়ী ভাবে। আর বিচারপতি আজিজসহ তার কমিশনের সদস্যরা এখন পর্যন্ত অনেকটা লোকচক্ষুর অন্তরালেই। অফ দ্য রেকর্ডে তারা তখন বলে গিয়েছিলেন, ভবিষ্যতে এ দেশের রাজনীতি ও রাজনীতিকদের ভাগ্যে অনেক দুর্গতি আছে। বদদোয়া বা ভবিষ্যৎদ্বাণী যা-ই হোক কথাতো বেঠিক বলে যাননি তারা। নইলে কেন নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশন প্রশ্নে আজও দুর্ভোগের সাগরে হাবুডুবু খেতে হচ্ছে তখনকার হারা-জেতাসহ গোটা দেশকে?
রাজনৈতিক-সামাজিক, পারিপার্শ্বিক নানা ঘটনা- দুর্ঘটনার মাঝে বাংলাদেশ নতুন করে সাংবিধানিক প্যাঁচে পড়লো প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা ইস্যুতে। একসময় বলা হয়েছে তিনি প্রাজ্ঞ, দক্ষ, সৎ, সাহসী, বিচক্ষণ আরো কতো কী? একজন সংখ্যালঘু বা হিন্দুকে দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের প্রধান বিচারপতি করে কতো বাহবাই না কুড়ানো হলো। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে সব উল্টে গেল। তিনি হয়ে গেলেন অসৎ। এমনকি রাজাকারও। আবার তিনি আসলে হিন্দুও না-এমন তথ্যও হাজির করা হয়েছে।
দুর্নীতি, অনিয়ম, অর্থনৈতিক অপকর্ম, নৈতিক স্খলনসহ ১১ অভিযোগ প্রচারও বাদ পড়েনি। মোটকথা তাকে মানুষের জায়গায়ই না রাখার যাবতীয় বন্দোবস্ত করে ফেলা হয়। শেষমেষ ক্যান্সার রোগী বানিয়ে দেশ ছাড়া। ছুটির আবেদন, চিকিৎসার্থে বিদেশ যাত্রার আবেদন, শেষমেষ বিদেশ থেকে পদত্যাগপত্র। প্যাঁচাল-ক্যাচালের আর কিছুই বাকি রাখা হলো না। এসবের সত্যতা প্রমাণের জন্য আইনমন্ত্রীর দাবি, তিনি ইহজীবনে কখনো মিথ্যা বলেননি। মানুষ যা বোঝার বুঝেছে। সরকার আরেকটু বেশি করে বুঝিয়ে ছেড়েছে। আর আনলিমিটেড বিনোদনতো দিয়েছেই। একদিকে আইনমন্ত্রীসহ সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা সংবিধানের ছবক শোনাচ্ছে প্রতিদিন। মানুষ একদিকে বিনোদিত হচ্ছে। আরেকদিকে কথা-আকথা গুজব-গুঞ্জনও চলছে ফ্রিস্টাইলে।
সংবিধানে কি আছে, আর কি নেই অল্পশিক্ষিত মানুষও এতোদিনে তা কম-বেশি বোঝে। অন্তত নিজের বুঝের জন্য কারো কাছ থেকে বুঝজ্ঞান হাওলাত করে না। বা করতে হয় না। সেইসাথে ভালো করেই জানে, ক্ষমতার ওপর কোনো দাওয়াই নেই। রাষ্ট্রপতি, প্রধান বিচারপতি আর প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে বহাল রাখার বিধি যেমন আছে, তেমন আছে খেদানোর বিধানও। আর রেওয়াজতো চালু হলোই। পুরো ব্যাপারটা নির্ভর করে ক্ষমতার ওপর। আমাদের আঞ্চলিক বাংলায় যাকে বলে, সেরের ওপর সোয়াসের। মাইরের ওপর দাওয়াই নাই।
শুনতে হালকা বা হাস্যকর মনে হলেও কথাটি একদিকে রুঢ় সত্য। আরেকদিকে নিষ্ঠুরতায় ভরা। আর দেশের জন্য আপদের। ভবিষ্যতের জন্য বিপদের। এসকে সিনহাকে সরকার কিভাবে, কোন ভয়ে হটিয়েছে সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের মানুষেরও জানার তেমন অবশিষ্ট নেই। যদিও সরকার বেশ তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে। আইনমন্ত্রী অত্যন্ত কনফিডেন্সের সঙ্গে বলেছেন, বর্তমানে প্রধান বিচারপতি নেই। এটা কোনো সমস্যাই না। সংবিধানে প্রধান বিচারপতি অনুপস্থিতিতে বা পদত্যাগ করলে কী হবে বা কে দায়িত্ব পালন করবেন, সংবিধানে তার সব ব্যবস্থা আছে।
কথা বড় সুন্দর। চমৎকারের চেয়েও চমৎকার। কিন্তু বিচারপতি এস কে সিনহাই কি শুধু হারলেন? সরকার চিরঞ্জীবের মতো জিতে গেছে? ক্যান্সারের কী হবে? কার ক্যান্সার কাকে ধরবে কি-না কে জানে? তার বিরুদ্ধে আনা ১১ অভিযোগের কী হবে? এই নরাধম বিচারপতির মৃত্যুদণ্ডসহ দেয়া রায়গুলোর যৌক্তিকতা দাঁড়াবে কোন মানদণ্ডে? এছাড়া প্রধান বিচারপতির বিতর্কিত সইযুক্ত ভুল বানান ও ভুল বাক্যে ভরা দুটি চিঠির একটিতে অসুস্থ, অন্যটিতে সুস্থ থাকা, লম্বা ছুটিতে স্ত্রীকে ছাড়াই একাকী যাত্রা, চাপে না স্বেচ্ছায় যাওয়া ও বিব্রত- শঙ্কিত হবার কথা বলা, ভুল বোঝাবুঝির শিকার হওয়া ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গের নিস্পত্তি তো হলোই না।
প্রসঙ্গক্রমে অধ্যাপক এ কিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে বিতাড়নের কথা এসেই যায়। যার বিস্তারিত বিবরণ ও পরিণতির উল্লেখ রয়েছে বাংলাদেশের (১৯৯১-২০০৬) রাজনীতির ওপর ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র’ নামে লেখা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের বইতে। ‘বাংলাদেশ : এ স্ট্যাডি অব দ্যা ডেমোক্রেটিক রেজিম’ শিরোনামে ইংরেজিতে লেখা তার বইটির প্রথম প্রকাশ ২০১২ সালে। সরকার ও বিরোধী দলে থাকাবস্থায় একজন সমালোচনামূলক রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে বইটি লেখেন তিনি। যা নিয়ে চরম আপত্তি তার দলের। কিন্তু তিনি বক্তব্যে অটল থেকে টিকে আছেন এখনো।
‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র’ বইয়ের ৩৮৫ পৃষ্ঠার দ্বিতীয় প্যারায় ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি যখন লাইফবয় সাবান কিংবা শপিং কমপ্লেক্সের মতো ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন বা উদ্বোধনের মতো অনুষ্ঠানে যোগ দিতে থাকেন এবং সেসব খবর প্রচারমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হতে থাকে, তখন তারা সবাই একে রাষ্ট্রপতির কার্যধারার মধ্যে ব্যতিক্রম হিসেবে মনে করতে থাকেন। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী একই দিনে দুটি পৃথক স্থানে কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলে মিডিয়া কাভারেজে প্রধানমন্ত্রীর চাইতে প্রটোকল অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া শুরু হয়।
এতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে মনে করা হতে থাকে যে, প্রধানমন্ত্রীর অবস্থানের অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে। ফলে রাষ্ট্রপতি ক্ষমতা গ্রহণের তিন মাসের কম সময়ের মধ্যে হাওয়া ভবনের উদীয়মান তরুণ গ্রুপ এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বদরুদ্দোজা চৌধুরীবিরোধী একটি প্রচারণা শুরু হয়। এই অনুমিত বিচ্যুতির বিষয়টিকে সমাধানের জন্য কোনো পক্ষ থেকেই কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ ধরনের মধ্যস্থতাকারী উদ্যোক্তার অনুপস্থিতিতে পরিস্থিতি দিন দিন বরং আরও খারাপের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
সংবিধান বা সাংবিধানিক বিষয় নিয়ে অতি রাজনীতি ও কথার কচলানির কী পরিণতি হয় বা হতে পারে ব্যারিস্টার মওদুদের বইয়ের একটা প্যারাই যথেষ্ট তথ্য দেয়। সুস্থ, বিবেকমান যে কারোই কামনা থাকবে, উপরোক্ত খারাপের দিকে আর না যাক বাংলাদেশ। রাষ্ট্র সম্পর্কিত আলোচনায় আইন প্রণয়ন, আইনী সিদ্ধান্ত গ্রহণ, আইনের উৎস বিষয়ে নানান গুরুত্বপূর্ণ অনুমান ও দার্শনিকতা এই সংবিধানকে ঘিরে বহাল থাকুক। প্যাঁচও থাকুক। কিন্তু প্যাঁচাল-ক্যাচাল যেন মাঠে-ঘাটে ছড়িয়ে-রটিয়ে আপদের সাথে নতুন বিপদ আর না আনে।
Leave a Reply